হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুবার্ষিকী আজ
সাদাকালো নিউজ
‘আমি জিজ্ঞেস করলাম, তার এখন কেমন লাগছে? তরুণ চিকিৎসক বলল, স্বপ্ন দেখার মতো। পুরো বিষয়টা তার কাছে মনে হচ্ছে, একটা স্বপ্নের মতো। একটু পরে আমি জিজ্ঞেস করলাম, যদি কোনো জাদুযন্ত্রবলে হঠাৎ সে জ্ঞান ফিরে পায়, হঠাৎ সে বেঁচে ওঠে, তাহলে কি সে আবার হুমায়ূন আহমেদ হয়ে বেঁচে থাকবে? তরুণ চিকিৎসক বলল, এখন যদি জেগে ওঠে তাহলে হবে, একটু পরে আর হবে না।
তার ব্লাড প্রেশার দ্রুত কমছে, তার মস্তিষ্কে রক্তপ্রবাহ কমছে, মস্তিষ্কের নিউরন সেল ধীরে ধীরে মারা যেতে শুরু করেছে। আমরা সবাই স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। কম বয়সী তরুণী একজন নার্স তার মাথার কাছে সব যন্ত্রপাতির কাছে দাঁড়িয়ে আছে। হুমায়ূন আহমেদের জীবনের শেষ মুহূর্তটি যেন কষ্টহীন হয় তার নিশ্চয়তা দেওয়ার চেষ্টা করছে। চারপাশে ঘিরে থাকা যন্ত্রপাতিগুলো এতদিন তাকে বাঁচিয়ে রেখে যেন ক্লান্ত হয়ে গেছে, এক-একটি যন্ত্র দেখাচ্ছে খুব ধীরে ধীরে তার জীবনের চিহ্নগুলো মুছে যেতে শুরু করেছে। ব্লাড প্রেশার যখন আরও কমে এসেছে আমি তখন তরুণ ডাক্তারকে আবার জিজ্ঞেস করলাম, এখন? এখন যদি হুমায়ূন আহমেদ বেঁচে ওঠে তাহলে কী হবে? ডাক্তার মাথা নেড়ে বলল, যদি এখন অলৌকিকভাবে তোমার ভাই জেগে ওঠে সে আর আগের মানুষটি থাকবে না। তার মস্তিষ্কের মাঝে এর মধ্যে অনেক নিউরন সেল মারা গেছে। আমি নিঃশব্দে হুমায়ূন আহমেদকে এই পৃথিবী থেকে বিদায় জানালাম। তার দেহটিতে এখনও জীবনের চিহ্ন আছে, কিন্তু আমার সামনে সে মানুষটি শুয়ে আছে। সে আর অসম্ভব সৃষ্টিশীল অসাধারণ প্রতিভাবান হুমায়ূন আহমেদ নয়। যে মস্তিষ্কটি তাকে অসম্ভব একজন সৃষ্টিশীল মানুষ করে রেখেছিল তার কাছে সেই মস্তিষ্কটি আর নেই। সেটি হারিয়ে গেছে।’
নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর ঠিক পরপর তার ছোট ভাই মুহম্মদ জাফর ইকবাল শেষ সময়ের এই বর্ণনা দেন; যা আজও আমাদের বেদনামথিত করে তোলে। ২০১২ সালের এই দিনে, বর্ষা ঋতুর এই ১৯ জুলাইয়ে না ফেরার দেশে চলে যান লেখক হুমাযূন আহমেদ। প্রতিবছর বর্ষায় তার হাজার হাজার মুগ্ধ পাঠকের মন কেঁদে ওঠে তাকে হারানোর ব্যথায়, আপনমনে তারা গেয়ে ওঠে তারই লেখা গান, ‘যদি মন কাঁদে তুমি চলে এসো, চলে এসো এক বরষায়।’
হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর সংবাদ শুনে নীলক্ষেতের ফুটপাথে বই বিক্রি করেন- এমন এক মধ্যবয়স্ক বিক্রেতা হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, ‘হুমায়ূন স্যারের বদলে আমি কেন মরলাম না!’ এই হলো জনপ্রিয়তা। এই হলো মানুষের ভালোবাসা। এখনও হুমায়ূন আহমেদের লেখা বইয়ের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে পাঠকদের মধ্যে। এখনও প্রতিবছরের বইমেলায় তার বই কেনেন অসংখ্য পাঠক। তার মৃত্যুর পর গত দশ বছরেও তার শূন্যতা কেউ পূরণ করতে পারেনি।
হুমায়ূন আহমেদ মানুষকে টেলিভিশনমুখীও করেছেন। বাংলা নাটকের তুমুল জনপ্রিয়তার অন্যতম কারিগর হুমায়ূন আহমেদ। বাংলা চলচ্চিত্রের দুর্দিনে ‘শঙ্খনীল কারাগার’, ‘আগুনের পরশমণি’ ইত্যাদি চলচ্চিত্র নির্মাণ করে দর্শকদের হলে টেনেছেন তিনি। উপন্যাস, নাটক কিংবা চলচ্চিত্র সবখানে হুমায়ূন আহমেদ নিজেকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন।
হুমায়ূন আহমেদ জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর। মা আয়েশা ফয়েজ ও বাবা ফয়জুর রহমানের প্রথম সন্তান তিনি। ফয়জুর রহমান একজন সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তাকে পাকিস্তানি বাহিনী নৃশংসভাবে হত্যা করে।
ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পর হুমায়ূন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন এবং নর্থ ডাকোটা স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পলিমার রসায়নশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। পরে লেখালেখি ও চলচ্চিত্র নির্মাণের লক্ষ্যে তিনি শিক্ষকতা ছেড়ে দেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানিরা হুমায়ূন আহমেদকেও বন্দি করেছিল। এ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, ‘সেই অভিজ্ঞতার কথা আমি লিখতে অনেকবার চেষ্টা করেছি, পারিনি। লিখতে বসলেই সব এলোমেলো হয়ে যায়। … কেন এ রকম হয় আমি জানি না, মনস্তত্ত্ববিদরা হয়তো-বা বলতে পারবেন। শুধু একটা স্মৃতি মনে আছে। ঠাণ্ডা মেঝেতে হাত-পা এলিয়ে আমি শুয়ে আছি এবং চিৎকার করছি পানি, পানি। চিৎকারের সঙ্গে সঙ্গে শাস্তি বন্ধ হলো। বদনায় করে আমার জন্য পানি আনা হলো।’
১৯৭২ সালে হুমায়ূন আহমেদের প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’ প্রকাশিত হয়। প্রথম উপন্যাস প্রকাশের পর থেকেই বিদগ্ধদের আলোচনায় চলে আসেন তিনি। বাংলা সাহিত্যে তিনি অমর হয়ে থাকবেন, এতে কোনো সংশয় নেই।