বাংলাদেশ সফর শেষে ইইউ প্রতিনিধি দল যে বার্তা নিয়ে গেল
সাদাকালো নিউজ
বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচনের আগে পরিস্থিতি বুঝতে দুই সপ্তাহ ধরে বাংলাদেশে প্রায় ১০০টি বৈঠক করে শনিবার মধ্যরাতে ঢাকা ছেড়ে গেছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিদল। আগামী নির্বাচনে ইইউ পর্যবেক্ষক পাঠাবে কিনা, সেটি পর্যালোচনা করে দেখতে বাংলাদেশে এসেছিল এই দলটি। এখন তারা তাদের অনুসন্ধানের ফলাফল একটি প্রতিবেদন আকারে জমা দেবে ইইউর পররাষ্ট্র বিষয়ক প্রধান জোসেফ বোরেলের কাছে। সেই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন নির্বাচন সংক্রান্ত পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ছয় সদসের ওই প্রতিনিধিদলটি বাংলাদেশে এসেছিল ৯ জুলাই। খবর বিবিসি।
বাংলাদেশে দুই সপ্তাহের সফরকালে কূটনীতিক, রাজনীতিবিদ, নির্বাচন কমিশন, নাগরিক সমাজ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, গণমাধ্যম এবং বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিদের সাথে বৈঠক করেছে। বাংলাদেশে যাদের সঙ্গে এই প্রতিনিধিদলের আলোচনা হয়েছে, তাদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে বোঝা যাচ্ছে যে, এই দলটি জানার চেষ্টা করেছে আগামী জাতীয় নির্বাচন কেমন হতে পারে, সেই সময়ের পরিবেশ নিয়ে ধারণা নেয়ার চেষ্টা করেছেন।
সেই সময় নির্বাচন কমিশন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গণমাধ্যমের ভূমিকা কেমন হবে আর রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচন নিয়ে অবস্থান কি হতে পারে, – সেটাও জানার চেষ্টা করেছেন তারা।
ইইউর এই প্রতিনিধিদল বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে কথা বলে এসব বিষয়ে তাদের মতামত নিয়েছে, দৃষ্টিভঙ্গি বোঝার চেষ্টা করেছে।
কোন বিষয়গুলোকে আলোচনায় প্রাধান্য দিয়েছে ইইউ প্রতিনিধিদল?
বাংলাদেশের যেসব পক্ষ বা সংস্থার প্রতিনিধিদের সাথে ইইউ প্রতিনিধিদলের আলোচনা হয়েছে, সেখানে মূলত গুরুত্ব পেয়েছে আগামী জাতীয় নির্বাচনের পরিবেশ, রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান, কূটনীতিক, গণমাধ্যম এবং নাগরিক সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি, প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রস্তুতির মতো বিষয়গুলো। যদিও এই সফরের আলোচনার বিষয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমকে সরাসরি কিছু জানানো হয়নি।
তবে তারা যাদের সঙ্গে বৈঠক বা আলোচনা করেছেন, তারা পরবর্তীতে গণমাধ্যমের কাছে আলাপের বিষয়বস্তু তুলে ধরেছেন। তা থেকে তাদের আগ্রহের বিষয়ে একটা ধারণা পাওয়া যায়।
নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে দুদফা বৈঠক করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিদল। সেখানে বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা, কমিশনের সক্ষমতা, আইন-কানুন, নির্বাচনের সময় সহিংসতার সম্ভাবনা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছে তারা। নির্বাচন অন্তর্ভুক্তিমূলক বা সব দলের অংশগ্রহণের সম্ভাবনা আছে কিনা, তাও জানতে চাওয়া হয়েছে। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের ক্ষেত্রে কমিশনের ভূমিকা কি হতে পারে, সেটা বোঝার চেষ্টা করেছে এই প্রতিনিধিদল।
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একই দিনে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী, এবি পার্টিসহ কয়েকটি দলের সঙ্গে বৈঠক করেছে প্রতিনিধিদল। সেসব বৈঠকের পর দলগুলোর নেতারা আলোচনার বিষয়বস্তু সাংবাদিকদের জানিয়েছেন।
বিএনপির সঙ্গে বৈঠকের পর আলোচনা প্রসঙ্গে বিএনপি নেতা আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী পরবর্তীতে সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘’তারা আমাদের কাছে জানতে চেয়েছে যে, বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন আদৌ জনগণের ভোটের মাধ্যমে সম্ভব হবে কিনা।… আমাদের পক্ষ থেকে তাদের বলেছি, এই সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাওয়ার কোন প্রশ্নই ওঠে না, সম্ভব না। কারণ এদের অধীনে নির্বাচন হবে না। “
বিএনপির সঙ্গে বৈঠকের পর দুপুর ১২টার দিকে ঢাকার একটি হোটেলে আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে ইইউ প্রতিনিধিদলের সদস্যরা। এরপর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘’একটি অবাধ, সুষ্ঠু এবং শান্তিপূর্ণ নির্বাচন তারা দেখতে চান, আমরাও বলেছি, অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগেরও কমিটমেন্ট। বাংলাদেশের সংবিধান, সার্বভৌমত্ব ও আইন ব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করে তারা এখানে নির্বাচন দেখতে চায়। তারা নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কারে আশ্বস্ত হয়েছেন বলে আমাদের জানিয়েছেন।‘’
‘’নো সংলাপ এবং নো তত্ত্বাবধায়ক সরকার। পার্লামেন্টের বিলুপ্তি, সরকারের পদত্যাগ, এসব কোন বিষয়েই আলোচনা হয়নি‘’ – বলেন মি. কাদের। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিয়েও কোন আলোচনা হয়নি বলে তিনি জানান।
আলোচনার সময় সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পক্ষে বক্তব্য তুলে ধরেছে জাতীয় পার্টি। তবে ইইউ প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আলোচনায় নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে কোন আলোচনা হয়নি বলে দলটির নেতারা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন।
ইইউ দলের সঙ্গে আলোচনার পর জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের বলেছেন, ‘’নির্বাচন কীভাবে স্বচ্ছ ও লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা যায়, সেই ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে। আমরা বলেছি, আমরা নির্বাচনে যেতে চাই, তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার হলে নির্বাচনে যাবো। আগামী নির্বাচনে ডেলিগেটস পাঠানোর ব্যাপারে তারা আমাদের মতামত চেয়েছিল। আমরা বলেছি, নিরপেক্ষ নির্দলীয় সরকারের অধীনে যদি নির্বাচন হয় তাহলে স্বাগতম। কিন্তু দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে ডেলিগেটস আসা ঠিক হবে না।‘’
দুই সপ্তাহের সফরকালে গণমাধ্যমের সম্পাদক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের সাথে বৈঠকের সময় বাংলাদেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
বৈঠক শেষে ডেইলি অবজারভার সম্পাদক ইকবাল সোবহান চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেছেন, ইইউ প্রতিনিধি দলকে জানানো হয়েছে যে, গণমাধ্যম কর্মীদের মধ্যে বিভেদ থাকলেও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে সবারই উদ্বেগ আছে। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য গণমাধ্যম ভূমিকা রাখবে বলে তাদের আশ্বস্ত করা হয়েছে। আর নিউ এজের সম্পাদক নুরুল কবির বলেছেন, তাদের অনুরোধ জানিয়েছি, যাতে ফিরে গিয়ে এমন রিপোর্ট না দেয়, আমরা সেই প্রত্যাশার কথা জানিয়েছি।
নাগরিক সমাজের মধ্যে বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিআইআইএসএস), মানবাধিকার সংস্থা অধিকার, সিপিডি, সুজনের সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করেছে ইইউ দলের সদস্যরা।
বৈঠক শেষে ড. মাহফুজ কবির সাংবাদিকদের বলেন, ইইউ প্রতিনিধিদল বর্তমান নির্বাচনের পরিবেশ সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়েছে। আমি তাদের বলেছি, এখন রাজনৈতিক পরিস্থিতি শান্তি ও সহিংসতা মুক্ত। নির্বাচনের আগে ইইউর উচিত একটি পর্যবেক্ষক দল পাঠানো। তারা পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি পর্যবেক্ষক দল পাঠানোর বিষয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করেছে।
আদিলুর রহমান খান বলেন, মানবাধিকার কর্মীদের নামে মামলা দিয়ে, মানবাধিকার সংগঠনের রেজিস্ট্রেশন বাতিল করে ও মানবাধিকার লঙ্ঘন করে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়, এটাই আমি প্রতিনিধিদলকে জানিয়েছি।
অন্যদিকে বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, দেশের অবস্থা সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সহায়ক কিনা, তারা সেটি জানতে চেয়েছে। অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে বলেছি, নির্বাচনের প্রক্রিয়াটা সঠিক হতে হবে।
দেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং তৃতীয় লিঙ্গের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও ইইউ দল আলোচনা করেছে। নির্বাচনের সময় তারা কি ধরনের সমস্যায় পড়েন, সেটা জানতে চাওয়া হয়েছে তাদের কাছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বৈঠকে ইইউ প্রতিনিধিরা জানতে চেয়েছেন, আগামী সংসদ নির্বাচনে তারা কীভাবে শান্তি বজায় রাখবে।