রণাঙ্গনের নায়ক আনহেল ডি মারিয়া!
সাদাকালো নিউজ
গ্রাসিয়েলডা কেমন আছে? সেই ভাংগাচোরা রংচটা হলুদ রংয়ের সাইকেলটা? প্যাডেল চেপে প্রতিদিন আঠারো কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতেন মা। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, ঘনকালো আঁধারো। তুমি যাতে রোজারিও সেন্ট্রালে অনুশীলন করতে পারো। হারকিউলেসকে মনে পড়ে?
সেই কার্গো বিমানটা? নাসিওনালের সাথে খেলতে গিয়ে যার পেছনে চেপে বসেছিলে তোমরা। আর্মির হেডফোনও ইঞ্জিনের তীব্র শব্দটাকে চাপা দিতে পারছিল না।
সব ফুটবলারের দুনিয়াটা গ্ল্যামারের চাকচিক্যে মোড়ানো হয়। অন্ধকার বিমানে বসে সেই কথাটা উপলব্ধি করেছিলে তুমি। আজ দেখো, চারিদিকে কত আলো! তোমার দ্যুতিতে আলোকিত রোজারিও, গোটা আর্জেন্টিনা। পুরো বিশ্বটাই।
মারাকানার কথা মনে পড়ে? ইঞ্জেকশনের পর ইঞ্জেকশন নিয়ে, দাঁতে দাঁত ঘষে মাঠে নামতে চেয়েছিলে তুমি। সাবেয়াকে মনের অবদমিত ইচ্ছের কথাগুলো বলতে গিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠেছিলে। শেষরক্ষা হয়নি, এঞ্জো পেরেজ মাঠে নামলো। তবুও স্বর্ণপিন্ডের শখটা তো অন্তত পূরণ হতো! মারিও গোটজা সেই আশাটাকে খুন করলো। স্বপ্ন দুয়ারে এসে অশ্রুবিসর্জনে বিদায়। মস্তিষ্কের কোটরে চিরদিনের জন্য অংকিত হাহাকার।
লুসাইলে সেই দুঃস্মৃতিই ঝাঁপিয়ে পড়ছিল নিউরনে। ৬৪ মিনিটে উঠে গেলে, আলবিসেলেস্তেদের খেলায় ধার কমে গেলো। পার্ক দে প্রিন্সে যার সাথে মাঠ ভাগাভাগি করতে, সেই এম্বাপ্পে ছেলেটা এবার আততায়ীর ভূমিকায়। শংকায়, সংশয়ে হৃদযন্ত্রের বেহাল অবস্থা।
হে প্রভু! যা হারিয়ে যাবার, সেটা বুঝি মিলবে না কভু। নাহ, এই ছেলেরা লড়তে জানে। মেসি, মার্তিনেজ, আলভারেজ, দে পলরা জমিন আঁকড়ে ছিল। বীরের বেশে বিশ্বজয়। রোজারিওর ছোট্ট আনহেল এখন পৃথিবীসেরা।
অদৃষ্ট অজানা, অদৃশ্য দেয়াল তুলে দাঁড়ায়। তবুও তুমি জিততে জানো, জেতাতে জানো। বেইজিংয়ের ফাইনালে আফ্রিকার সুপার ঈগলদেরকে পরাস্ত করেছ।
সাত বছর পর মারাকানায় ফিরে মাখনে ছুরি চালানোর মত মোলায়েম স্পর্শে চিপ। ওমন একখানা গোল ছিল ফিনালিসিমাতেই। দেশের জন্য, দশের জন্য সংকাটাপণ্ণ মুহূর্তে আনহেল স্বয়ং স্বর্গরাজা থেকে প্রেরিত দেবদূত। হবে না কেন, তোমার নামই যে ওটা।
চারকোল বানিয়ে সংসার চালাতে হতো বাবাকে। তাই ক্ষুদে বাড়িটার সাদা দেয়ালটা ফ্যাকাশে দেখাতো। পেটের দায়ে তোমাকেও কাজ করতে হতো। পরিশ্রম, নিষ্ঠা আর প্রতিভা। ভাগ্যের একটু স্পর্শ পেলে আর এই তিনের সংযোগ হলে পাহাড় ঠেলা সম্ভব।
আজ তোমার কারণেই হাসছে পুরো দেশ। তোমাদের দেয়ালটা হয়তো সাদা থাকতে পারেনি। আজ বুয়োনোস আইরেস, রোজারিও, সান্তা রোজারিও কিংবা কর্ডোবার দেয়ালে দেয়ালে তোমার হাসিমাখা মুখখানা আঁকা যত্ন ভরে। তোমার শংসাবাণীর কালো কালিতে সাদা ঢেকে গেছে। ভাবতে পারো?
আজ জীবন তোমাকে চূড়োয় নিয়ে এসেছে। এই প্রাণটাই একদিন ছিল প্রবঞ্চনা, বঞ্চনা আর বিসর্জনের। মানব হয়ে জন্মানোর পর নিয়মিত অদ্ভুতভাবে খেলা করে। সেই খেয়ালি ক্রীড়ায় তুমি বিজেতা।
মিয়া কেমন আছে? দু’মাস আগেভাগেই পৃথিবীতে চলে এসেছিল যে? নল আর তারের জঞ্জালের মধ্যে ক্ষুদে হৃদপিণ্ডের শব্দ শোনার জন্য আকুল হতো পিতার মন। ওর গলায় মেডেলটা পরিয়েছিলে তো?
ম্যাক অ্যালিস্টার পাসটা একেবারে মাপমতো। এবার অবশ্য চিপ না। ভূমির দিকে মারলে বলটা, একবার মাটি স্পর্শ করে লরিসের ভূপতিত দেহের উপর দিয়ে জালে। আনহেল ফাবিয়ান দি মারিয়া ভুল করেনি। আরেকবার ফাইনালে আলবিসেলেস্তেদের ত্রাতার ভূমিকায় আবির্ভাব। বড় ম্যাচে জ্বলে উঠতে পারে মানুষটা। জিততে জানে, জেতাতে জানে।
মানুষ আর বাঁচেই বা ক’দিন? এতশত স্মৃতির মিছিলে সম্মুখসারিতে রয়ে যায় কিছু। লুসাইলে গোলের পর খুশির কান্না। গ্রাসিয়েলডার পেছনের সিটে বসে স্বপ্ন ধাওয়া করা।
অতলান্তের জলরাশি পেরিয়ে বেনফিকার লালে ভাগ্যকে সমর্পণ।
সেই শীর্ণকায় ছেলেটা কয়লায় মাখামাখি। বৃষ্টি মাথায় কাজ করছেন বাবা। তোমার জন্য, তুমি স্বপ্ন ছুঁবে বলে।
আনহেল দি মারিয়া পেরেছে। আলবিসেলেস্তেদের তিন যুগের অপেক্ষা শেষ। আকাশী-সাদায় ঢেকে গেছে পুরো বিশ্বটাই। স্বপ্ন ছুঁয়ে দেখেছ। আজ চারদিকে তোমার বন্দনা কাব্য। আজ তুমি বাঁধনহারা। উদাত্ত কণ্ঠস্বরে চাইলেই ঘোষণা করতে পারোঃ
“রণাঙ্গনের নায়ক আমি
ছুটে চলেছি বীরের বেশে দেশে দেশে,
কখনও বা মরুভূমির বুকে নির্ভীক চোখে।
পার করেছি সাত সমুদ্র তের নদী,
জয় করেছি লাখো মানুষের মন অদ্যাবধি।”
লেখকঃ মিরাজ হোসাইন