দেশে স্বর্ণের দাম বাড়ানো কতটা যৌক্তিক
সাদাকালো নিউজ
গত মে মাসের শুরুতে বিশ্ববাজারে হঠাৎ স্বর্ণের দাম বাড়তে শুরু করে। তখন প্রতি আউন্স (৩১.১০৩৪৭৬৮ গ্রাম) স্বর্ণের দাম বেড়ে ২ হাজার ৫২ মার্কিন ডলার পর্যন্ত ওঠে। বর্তমানে প্রতি আউন্সের দাম ১ হাজার ৯৬৫ ডলার। কিন্তু বিশ্ববাজারে দর কমলেও দেশে স্বর্ণের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি(বাজুস)। এতে প্রথমবারের মতো প্রতি ভরি স্বর্ণের দাম ছাড়িয়ে গেছে লাখ টাকারও বেশি।
গত মে মাসের শুরুতে দেশের বাজারে ২২ ক্যারেট স্বর্ণের ভরিপ্রতি দাম ছিল ৯৮ হাজার ৪৪৪ টাকা। গত শুক্রবার থেকে প্রতি ভরি বিক্রি হচ্ছে ১ লাখ ৭৭৭ টাকা। এই সময়ের মধ্যে টাকার বিপরীতে ডলারের বিনিময় হারেও বড় কোনো উত্থান হয়নি। শুধু ব্যাগেজ রুলসের আওতায় বিদেশ থেকে স্বর্ণ আনার ক্ষেত্রে প্রতি ভরিতে শুল্ক-কর ২ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪ হাজার টাকা করা হয়। অথচ বিশ্ববাজারে প্রতি ভরিতে দাম কমপক্ষে তিন হাজার টাকা।
বাজুসের নেতারা বলছেন, শুল্ক-কর বৃদ্ধি ও পরিমাণ আগের চেয়ে কমিয়ে দেয়ায় ব্যাগেজ রুলসের আওতায় বিদেশ থেকে স্বর্ণ নিয়ে আসা কমেছে। পুরোনো অলংকার বিক্রি করতে আসা গ্রাহকের সংখ্যাও তুলনামূলক কম। ফলে স্থানীয় বুলিয়ন বাজারে বিশুদ্ধ স্বর্ণের দাম বাড়ার ভিত্তিতে দাম সমন্বয় করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উচ্চ মূল্যের কারণে স্বর্ণের অলংকার সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাওয়ায় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাও হারিয়ে যাচ্ছেন। এমন বাস্তবতায় স্বর্ণের দাম নির্ধারণের প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা দরকার। আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে দেশের বাজারে স্বর্ণের দামের ফারাক কমিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।
ব্যবসায়ীরা জানান, দেশে গত বৃহস্পতিবার প্রতি ভরি বিশুদ্ধ স্বর্ণ বিক্রি হয়েছে ৮৯ হাজার থেকে ৯০ হাজার টাকায়। সেই হিসাবে এক ভরি ২২ ক্যারেট স্বর্ণের দাম পড়ে ৮২ হাজার ২০৪ টাকা। যদিও এক ভরি স্বর্ণের অলংকার কিনতে বা বানাতে গেলে দিতে হবে ১ লাখ ৭৭৭ টাকা। এর সঙ্গে আছে অলংকার তৈরির কারিগরের মজুরি।
বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির (বাজুস) সহসভাপতি দেওয়ান আমিনুল ইসলাম গণমাধ্যমে বলেন, ‘স্থানীয় বুলিয়ন মার্কেটে প্রতি ভরি বিশুদ্ধ স্বর্ণের দাম ৯০ হাজার টাকায় উঠেছে। এই হিসাবে আমাদের দাম আরও বাড়ানোর প্রয়োজন ছিল। সরাসরি আমদানি হলে স্বর্ণের দাম ভরিতে ৩ হাজার টাকা কম হতো।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জুয়েলারিশিল্পে শৃঙ্খলা আনতে স্বর্ণ নীতিমালা প্রণয়ন করে। সেই নীতিমালার আলোকে স্বর্ণ আমদানির জন্য ২০১৯ সালে নভেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি বাণিজ্যিক ব্যাংকসহ ১৮টি প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দেয়। পরে আরও একটি প্রতিষ্ঠান লাইসেন্স পায়। প্রথম কিছুদিন আমদানি হলেও পরে নানা জটিলতায় তা আটকে যায়। জানা গেছে, বর্তমানে ডলার সংকটের কারণে বন্ধ রয়েছে স্বর্ণের আমদানি।
গতকাল শুক্রবার আন্তর্জাতিক কমোডিটি এক্সচেঞ্জ মার্কেটে একপর্যায়ে বিশুদ্ধ বা ২৪ ক্যারেটের প্রতি আউন্স স্বর্ণের দাম ছিল ১ হাজার ৯৬৫ ডলার। তার মানে প্রতি ভরি ৭৩৬ ডলার ৮৮ সেন্ট, যা দেশি মুদ্রায় দাঁড়ায় ৮১ হাজার ৫৭ টাকা (প্রতি ডলার = ১১০ টাকা হিসাবে)। ২৪ ক্যারেট স্বর্ণের বারে ৯৯ দশমিক ৯৯ শতাংশ বিশুদ্ধ স্বর্ণ পাওয়া যায়। আর ২২ ক্যারেটে এই হার ৯১ দশমিক ৬৭ শতাংশ। সেই হিসাবে ২২ ক্যারেট স্বর্ণের ভরিপ্রতি প্রকৃত দাম হতে পারে ৭৪ হাজার ৬৫৮ টাকা। বৈধভাবে এই স্বর্ণ আমদানি করলে ২ শতাংশ বা দেড় হাজার টাকা সম্পূরক শুল্ক দিতে হতো।
জুয়েলার্স সমিতির সাধারণ সম্পাদক দিলীপ কুমার আগারওয়াল বলেন, ব্যাগেজ রুলসের আওতায় স্বর্ণ আনলেই এখন ভরিতে সাত হাজার থেকে আট হাজার টাকা খরচ হয়। এর মধ্যে যিনি বিদেশ থেকে আনেন, তিনি তিন-চার হাজার টাকা নেন। শুল্ক-কর আছে চার হাজার টাকা। উন্নত দেশে স্বর্ণের অলংকার তৈরির কারিগরদের ৩ শতাংশ অপচয় দেয়া হয়। আমাদের দেশে উন্নত যন্ত্রপাতির ব্যবহার না থাকায় সেটি ১০-১১ শতাংশ। এতেই স্বর্ণের দাম বেড়ে যায়।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, জুয়েলার্স সমিতি অলিখিতভাবে স্বর্ণের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে, তারাই দাম নির্ধারণ করে। কিন্তু দেশে নির্ধারিত দর স্বর্ণের বৈশ্বিক দরের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট দপ্তর এই বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখতে পারে।