ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম রোধে গণসচেতনতা প্রয়োজন
সাদাকালো নিউজ
স্বল্পায়ু কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য তার ছাড়পত্র কবিতার শেষাংশে লিখেছেন, ‘এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য ক’রে যাব আমি/ নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার। /অবশেষে সব কাজ সেরে/ আমার দেহের রক্তে নতুন শিশুকে / করে যাব আশীর্বাদ, / তারপর হব ইতিহাস।’ এরপর সমাজের অনেক বিবর্তন ঘটেছে, কত অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত হয়েছে শিশুশ্রম বন্ধের লক্ষ্যে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারক ও সমাজের বিভিন্ন স্তরের প্রতিনিধিদের তরফে, কিন্তু তার পরও কাটেনি আঁধার।
সরকার লক্ষ্য ঠিক করেছিল, ২০২৫ সালের মধ্যে সব ধরনের শিশুশ্রম নিরসন করবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, নিরসন তো দূরের কথা, গত এক দশকে এই হার আরও বেড়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) জরিপে জানা যায়, ২০১৩ সালে দেশে কর্মে নিয়োজিত শিশুর সংখ্যা ছিল প্রায় ৩৪ লাখ ৫০ হাজার ৩৬৯। ২০২২ সালে এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৫ লাখ ৩৬ হাজার ৯৮৭ জনে। বিবিএসের প্রতিবেদনে এও বলা হয়েছে, গত এক দশকে দুই লাখ ১২ হাজার শিশুশ্রমিক ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে ফিরে এসেছে। যদিও অঙ্গীকার ছিল এই সময়ে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার। জানা গেছে, ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসনের লক্ষ্যে দুই হাজার ৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হচ্ছে, যার মাধ্যমে বাকি ১০ লাখেরও বেশি শিশুকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজের গণ্ডি থেকে বের করে আনার অঙ্গীকার রয়েছে। বিবিএসের সাম্প্রতিক সমীক্ষায় দেশে শিশুশ্রম ও শিশুশ্রমিকের যে চিত্র উঠে এসেছে, তা আমাদের উদ্বিগ্ন না করে পারে না।
উল্লিখিত পরিসংখ্যান সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছে, দেশটাকে সব শিশুর জন্য বাসযোগ্য করে তোলা যায়নি। বলা হয়ে থাকে, আজকের শিশুরাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। কিন্তু বিদ্যমান বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন দাঁড়ায় এই ভবিষ্যৎ কর্ণধাররা শুধুই কি আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে জিইয়ে থাকা বৈষম্যের শিকার? আমরা মনে করি, বৈষম্যের পাশাপাশি অধিকারের অনেক ক্ষেত্রেই বিরাজমান নানানরকম প্রতিবন্ধকতা এই প্রেক্ষাপটের জন্য বহুলাংশে দায়ী। প্রতিটি শিশুর জন্য নাগরিকের মৌলিক চাহিদা অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, বাসস্থান ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণের ক্ষেত্রে কর্মপরিকল্পনা রয়েছে বটে, কিন্তু এর বাস্তবায়নের গতি অত্যন্ত মন্থর। দেশে লাখ লাখ শিশু যখন অমানবিক ও অমর্যাদাকর জীবন যাপন করছে, তখন উন্নয়ন-অগ্রগতি কিংবা সমৃদ্ধির তথ্যচিত্র যেন পরিহাসের মতো শোনায়। রাষ্ট্র যদি প্রজন্মের উল্লেখযোগ্য এই অংশের মৌলিক চাহিদা মেটাতে পারত, তাহলে জীবিকার সন্ধানে শিশুশ্রমের মতো অমানবিকতার ছায়া গ্রাস করত না। সংবাদমাধ্যমেই ইতঃপূর্বে উঠে এসেছে একদিকে শিশুশ্রমের মতো বৈরী পরিস্থিতির পরিসর ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে, অন্যদিকে তারা তাদের শ্রমের নায্যমূল্যও পায় না। এমনটি শুধু অমানবিকই নয়, অমার্জনীয়ও বটে। আমরা মনে করি, আমাদের উন্নয়ন পরিকল্পনা ও অধিকারের বাস্তবায়নের পথ মসৃণ না করে একই সঙ্গে বাস্তবানুগ পদক্ষেপ না নিলে এই আঁধার ঘোচানো দুরূহই হয়ে থাকবে। সব শিশুর জন্য বাসাযোগ্য দেশ এবং তাদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ার প্রত্যয় বাস্তবায়নে শিশুশ্রম বন্ধে যে আইন রয়েছে এর যথাযথ প্রয়োগ জরুরি।
দুঃখজনক হলেও সত্য, সমাজের বিভিন্ন স্তরে শিশুশ্রম যেন এখনও ‘স্বাভাবিক’ ঘটনা। শিশুশ্রম রোধ করার লক্ষ্যে শিক্ষা লাভের পথ আরও মসৃণ করার পাশাপাশি স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি আরও কিছু কর্মপরিকল্পনা জরুরি। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় বলা হয়েছে, সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে শিশুদের সরিয়ে আনার জন্য রাষ্ট্রগুলোকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। আমরা জানি, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) শ্রমিক নিয়োগ সম্পর্কে যে মানদণ্ড নির্দিষ্ট করে দিয়েছে, সেখানে মূলত চারটি মাত্রার কথা বলা হয়েছে। এগুলো হলো- সংগঠিত হওয়ার স্বাধীনতা, যৌথ দর-কষাকষির অঙ্গীকার, বৈষম্যহীন নিয়োগব্যবস্থা ও নিরাপত্তা। কিন্তু এর প্রয়োগ কৌশল নিয়ে বরাবরই প্রশ্ন রয়েছে।
সমাজে শিশুদের শুধু অনৈতিকভাবে শ্রমেই নিযুক্ত করা হচ্ছে না, তাদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডেও যুক্ত করছে অশুভচক্র। শিশুশ্রম নিরসনে আরও জোরদার উদ্যোগ নেওয়ার পাশাপাশি যারা শিশুদের সমাজবিরোধী কর্মকাণ্ডের পথে টেনে নেয়, তাদের চিহ্নিত করে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থাও নিশ্চিত করতে হবে। মনে রাখা উচিত, শিশুশ্রম শুধু একটি শিশু বা তার পরিবারকেই ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে না, বরং অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে ফেলে সব সম্ভাবনা। শিশুশ্রম নিরসনে জরুরি রাজনৈতিক সদিচ্ছাও। অন্ধকার দূর করতে সবাইকে যূথবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।