কে এই ‘ফিটিং মনির’? যেভাবে পথে বসিয়েছেন ব্যবসায়ীদের
জহুরা প্রিতু
ফরিদপুরের মৃধা মনিরুজ্জামান। এলাকায় পরিচিত ‘ফিটিং মনির’নামে। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে প্রতারণা করে গত এক যুগে তিনটি জুট মিলসহ অন্তত সাতটি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের অংশীদার হয়েছেন। পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনের নামে-বেনামে রয়েছে আরো ছয়টি পাট সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান।
পুলিশ বলছে, আয়ের লোভ দেখিয়ে মানূষকে তাঁর ব্যাবসায়িক অংশীদার করেন মনির। এরপর সেই ব্যবসাকে ঝুঁকিতে ফেলেন নিজেই। তারপর ব্যবসার পুরো মালিকানা নিজের করে নেন। এই কাজে দক্ষতার জন্যই মৃধা মনিরুজ্জামান থেকে তিনি পরিচিতি পান ফিটিং মনির নামে।
তাঁর বিরুদ্ধে আছে একাধিক মামলা। মামলার তদন্ত সূত্র বলছে, মনির যুবদলের সাবেক নেতা। ছিলেন জাতীয়তাবাদী যুবদলের সহসভাপতি। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্ত শুরু হয় বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেই।
২০০২ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত আয়কর রিটার্নের একটি প্রতিবেদন তিনি দুদকে জমা দেন। রিটার্ন পর্যালোচনা করে দুদক ৯৮ লাখ টাকা অবৈধ আয়ের প্রমাণ পায়। এরপর দুদকের সহকারী পরিচালক রাজকুমার সাহা ২০১৯ সালের ২৭ মে দুর্নীতি দমন প্রতিরোধ আইনে একটি মামলা করেন। ওই বছরের ৩০ জুলাই কারাগারে যান মৃধা মনিরুজ্জামান। থাকতে হয় কয়েক মাস।
দুদকের অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তথ্য মতে, লাভজনক ব্যবসার প্রলোভন দেখিয়ে বিত্তশালীদের নিয়ে প্রথমে একটি কোম্পানি করেন মৃধা মনিরুজ্জামান। পরে ওই প্রতিষ্ঠানটি অল্প সময়ের মধ্যে ‘অলাভজনক’ দেখাতে শুরু করেন। এক পর্যায়ে ব্যবসার অন্য অংশীদারদের কাছ থেকে নামমাত্র মূল্যে শেয়ার কিনে নেন নিজেই।
সৌদিপ্রবাসী একজন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে পুঁজি নিয়ে ফরিদপুরের মধুখালীতে দাহমাশি জুট মিল গড়ে তোলেন মৃধা মনিরুজ্জামান। পরে অভিযোগ ওঠে, নিজের পাট সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কম দামে নিম্নমানের পাট দিয়ে বাড়তি দাম দেখিয়ে ওই টাকা হাতিয়ে নেয়ার। পাট সরবরাহ না করেও বিল উঠিয়ে নেয়ার অভিযোগও ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে। মনিরুজ্জামান কোম্পানির টাকায় কেনা পাট দিয়ে উৎপাদিত সুতা চোরাইপথে ভারতে পাচার করেন।
ভালো সুতা নষ্ট দেখিয়েও তিনি কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন বলে অভিযোগ। এভাবে প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা অনিয়ম করার বিষয়টি ধরা পড়ে কোম্পানির অডিটেও। এ অবস্থায় তিনি ওই মিলের শেয়ার নির্ধারিত দামে মূল উদ্যোক্তার কাছে বিক্রি করে দেন। এখন আবার বিএনপি-জামায়াত ক্যাডারদের দিয়ে মিলটি দখলের অপচেষ্টা চালাচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
দাহমাশির মতো গোল্ডেন ও প্রাইড জুট মিল নামের দুটি কারখানার মাধ্যমেও বিপুল অর্থ নয়ছয়ের অভিযোগ মনিরের বিরুদ্ধে। দুটি মিলেরই ব্যবস্থাপনা পরিচালক মৃধা মনিরুজ্জামান।
একই কৌশলে গত এক যুগে তিনটি জুট মিলসহ অন্তত সাতটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে বিপুল অর্থের মালিক হয়েছেন মনির। পথে বসেছেন তাঁর একসময়ের অংশীদাররা। দুদকের মামলায় জামিন নিতে যাওয়ার পর জাতীয়তাবাদী যুবদলের সাবেক এই সহসভাপতিকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
এর আগেও দুদকের মামলায় বেশ কয়েক মাস জেল খেটেছেন মনির। তাঁর বিরুদ্ধে প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদের মালিক হওয়ার তথ্য-প্রমাণ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন। বিএনপি-জামায়াতের জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলনের অন্যতম অর্থায়নকারী মনিরের বিরুদ্ধে ৪৬ কোটি টাকা আত্মসাতের একটি মামলায়ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে।
গত পয়লা মার্চ একজন প্রবাসী উদ্যোক্তা তাঁর বিরুদ্ধে প্রায় ৪৬ কোটি টাকা আত্মসাৎ ও হত্যার হুমকির অভিযোগ এনে মামলা করেন রাজধানীর বনানী থানায়। মামলা নম্বর-২। মামলাটি তদন্ত করছে সিআইডি।
দুদক কর্মকর্তারা জানান, ফরিদপুরের বিশেষ ট্রাইব্যুনালের মামলার নম্বর ০২/২১ এর আসামি মৃধা মনিরুজ্জামান। তার বিরুদ্ধে অবৈধ আয়ের প্রমাণ পেয়ে চার্জশিট দিয়েছে দুদক। গত ২০ সেপ্টেম্বর ঢাকার একটি আদালতে হাজির হলে তাঁকে ফরিদপুর কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়।