কর্ণফুলীর টানেলে ‘সাত তারকা’ অতিথিশালা খালি পড়ে আছে
বিলাসবহুল একটি অতিথিশালা নির্মাণ করতে গিয়ে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত টানেল প্রকল্পের ব্যয় অনেকটা বেড়েছে। সেই অতিথিশালা এখন খালি পড়ে আছে। আর প্রতিদিন বিপুল লোকসান দিচ্ছে টানেল।
অতিথিশালাটিতে রয়েছে প্রায় পাঁচ হাজার বর্গফুট আয়তনের আধুনিক সুসজ্জিত একটি বাংলো। এতে রয়েছে ছয়টি কক্ষ। সামনেই সুইমিংপুল। সেতু বিভাগ সূত্র বলছে, এই অতিথিশালা নির্মাণ করা হয়েছিল ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরের কথা মাথায় রেখে। তিনি গেলে সেখানে থাকবেন, এমন চিন্তা ছিল প্রকল্পের কর্মকর্তাদের। এই অতিথিশালা ছাড়াও নির্মাণ করা হয়েছে ৩০টি রেস্টহাউস বা বিশ্রামাগার।
সেতু বিভাগ বলছে, অতিথিশালা তৈরি হলেও তা কখনোই চালু হয়নি। কারণ, সেটা চালু করার মতো জনবল নেই। যদিও ব্যয় করা হয়েছে সাড়ে চার শ কোটি টাকার মতো।
অতিথিশালাটিতে রয়েছে প্রায় পাঁচ হাজার বর্গফুট আয়তনের আধুনিক সুসজ্জিত একটি বাংলো। এতে রয়েছে ছয়টি কক্ষ। সামনেই সুইমিংপুল। সেতু বিভাগ সূত্র বলছে, এই অতিথিশালা নির্মাণ করা হয়েছিল ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরের কথা মাথায় রেখে। তিনি গেলে সেখানে থাকবেন, এমন চিন্তা ছিল প্রকল্পের কর্মকর্তাদের।
কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে চালু হয়। টানেলটি দিয়ে যানবাহন চলাচলের যে সম্ভাবনার কথা শোনানো হয়েছিল, তা এখন ‘গালগল্পে’ পরিণত হয়েছে। ফলে টোল আদায়ও অনেক কম। এখন মাসে টোল আদায় হচ্ছে গড়ে আড়াই কোটি টাকা। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণে নিযুক্ত ঠিকাদারের পেছনে মাসে খরচ প্রায় সাড়ে ১১ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রতি মাসে গড়ে ঘাটতি প্রায় সাড়ে ৯ কোটি টাকা।
অন্তর্বর্তী সরকার টানেলটি নিয়ে বিপাকে পড়েছে। সড়ক পরিবহন ও সেতু বিভাগের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান টানেলের লোকসান কমাতে কিছু উদ্যোগ নিয়েছেন। তিনি বলেন, টানেল প্রকল্পের আওতায় নির্মিত অতিথিশালা সাত তারকা (সেভেন স্টার, যা অত্যন্ত বিলাসবহুল) মানের। এমনিতে যৌক্তিকতা বিবেচনা না করে টানেল নির্মাণ করা হয়েছে। এরপর আজগুবি কাজ যুক্ত করে ব্যয় বাড়ানো হয়েছে।
উল্লেখ্য, টানেল নির্মাণে শুরুতে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৮ হাজার ৪৪৬ কোটি টাকা। কঠিন শর্তের চীনা ঋণে নেওয়া প্রকল্পের ব্যয় তিন দফা বাড়ানোর পর ব্যয় দাঁড়ায় ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকায়।
সেতু বিভাগ বলছে, অতিথিশালা তৈরি হলেও তা কখনোই চালু হয়নি। কারণ, সেটা চালু করার মতো জনবল নেই। যদিও ব্যয় করা হয়েছে সাড়ে চার শ কোটি টাকার মতো।
যা আছে অতিথিশালায়
টানেল নির্মাণ প্রকল্পে যে জায়গায় অতিথিশালা নির্মাণ করা হয়েছে, সেটাকে বলা হয় ‘সার্ভিস এরিয়া’। প্রকল্পের শুরুতে ‘সার্ভিস এরিয়া’ ছিল না। মাঝপথে তা যুক্ত করে প্রায় ৭২ একর জায়গাজুড়ে নানা স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে। এটি গড়ে তোলা হয়েছে চট্টগ্রামের আনোয়ারা এলাকায় টানেলের দক্ষিণ প্রান্তে পারকি খালের পাশে। সেখান থেকে কিছুটা দূরে সমুদ্রসৈকত।
সার্ভিস এরিয়াজুড়ে বাংলো ও রেস্টহাউস ছাড়া রয়েছে টানেলের একটি রেপ্লিকা, সম্মেলনকেন্দ্র, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, হেলিপ্যাড, মসজিদ, পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন। আরও রয়েছে চট্টগ্রামের ঐতিহ্য ও বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিচিহ্ন নিয়ে একটি জাদুঘর। এসব স্থাপনায় শীতাতপনিয়ন্ত্রণ-ব্যবস্থা (এসি) বসানো হয়েছে ১ হাজার ১৮২ টন ক্ষমতার।
সেতু বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, টানেল প্রকল্পের শেষ সময়ে অতিথিশালা যুক্ত করার নেপথ্যে ছিলেন তখনকার সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েরও সম্মতি ছিল। ওবায়দুল কাদের এখন আত্মগোপনে। তাই তাঁর বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
সার্ভিস এরিয়াজুড়ে বাংলো ও রেস্টহাউস ছাড়া রয়েছে টানেলের একটি রেপ্লিকা, সম্মেলনকেন্দ্র, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, হেলিপ্যাড, মসজিদ, পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন। আরও রয়েছে চট্টগ্রামের ঐতিহ্য ও বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিচিহ্ন নিয়ে একটি জাদুঘর।
সেতু বিভাগ ও পর্যটন করপোরেশন সূত্র জানিয়েছে, আনোয়ারায় পারকি সৈকতের পাশে পর্যটন করপোরেশনের উদ্যোগে ১৩ একরের বেশি জমিতে ৭৯ কোটি টাকা ব্যয়ে অত্যাধুনিক পর্যটন কমপ্লেক্স নির্মাণ করছে পর্যটন করপোরেশন। এটি টানেলের অতিথিশালা থেকে মাত্র দেড় কিলোমিটার দূরে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে পর্যটন কমপ্লেক্স নির্মাণের প্রকল্প নেওয়া হয়। শেষ হওয়ার কথা ২০২২ সালের ডিসেম্বরে। যদিও এখন পর্যন্ত কাজ হয়েছে ৮০ শতাংশ। এই প্রকল্পের অধীন গড়ে তোলা হচ্ছে ১০টি একক বা সিঙ্গেল কটেজ, চারটি ডুপ্লেক্স কটেজ এবং তিনতলার একটি মাল্টিপারপাস (বহুমুখী ব্যবহার) ভবন। পর্যটন কমপ্লেক্সে হ্রদ ও শিশুদের খেলাধুলার জায়গাসহ নানা স্থাপনা থাকবে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, টানেল প্রকল্পে অতিথিশালা নির্মাণের কোনো প্রয়োজনই ছিল না। পর্যটন করপোরেশনের পর্যটন কমপ্লেক্সই সেখানে যথেষ্ট।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক মইনুল ইসলাম বলেন, কর্ণফুলী টানেল এমনিতেই আগামী পাঁচ থেকে সাত বছর পুরোপুরি ব্যবহার হবে না। এই সময়ে টোল থেকে যে আয় হবে তা দিয়ে রক্ষণাবেক্ষণ খরচের চার ভাগের এক ভাগও উঠবে না। এর মধ্যে শেষ সময়ে এসে টানেল প্রকল্পে বিপুল টাকায় অতিথিশালা করার কোনো প্রয়োজন ছিল না। তিনি বলেন, মূলত প্রকল্পের বিভিন্ন খাতে ব্যয় দেখিয়ে টাকা লুট করার জন্য এগুলো করা হয়।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, টানেল প্রকল্পে অতিথিশালা নির্মাণের কোনো প্রয়োজনই ছিল না। পর্যটন করপোরেশনের পর্যটন কমপ্লেক্সই সেখানে যথেষ্ট।
টানেলের ব্যয় বাড়ে তিন দফা
বিগত আওয়ামী লীগ সরকার বন্দরনগরকে চীনের সাংহাইয়ের মতো ‘ওয়ান সিটি, টু টাউন’ মডেলে পরিণত করার কথা বলে টানেল প্রকল্প নেয়। টানেলটি দক্ষিণ চট্টগ্রামের পতেঙ্গা ও আনোয়ারা উপজেলাকে সংযুক্ত করেছে। প্রকল্পটি অনুমোদন পায় ২০১৫ সালের নভেম্বরে।
সরকারের সঙ্গে সরকারের চুক্তি (জিটুজি) পদ্ধতিতে চীনের অর্থায়নে এবং ওই দেশের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান টানেলটি নির্মাণ করেছে। শুরুতে প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ৮ হাজার ৪৪৬ কোটি টাকা। যদিও চীনের ঋণচুক্তি সম্পাদনে দেরি হওয়ায় টানেলের নির্মাণকাজ শুরু হয় আরও দুই বছর পর। আর জমি অধিগ্রহণের পরিমাণ বৃদ্ধি, শুল্ক–করহার বৃদ্ধি, পরিষেবা সংযোগ লাইন স্থানান্তর ইত্যাদি খাতে ব্যয় বৃদ্ধির কথা উল্লেখ করে ২০২০ সালে নির্মাণ ব্যয় বাড়িয়ে ধরা হয় ৯ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা। ২০২১ সালে জরুরি ভিত্তিতে আরও ৪৯৪ কোটি টাকা ব্যয় বৃদ্ধি করে কর্তৃপক্ষ। এতে ব্যয় দাঁড়ায় মোট ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা।
সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, অতিথিশালাসহ সার্ভিস এলাকা নির্মাণের সিদ্ধান্তের পরই দ্বিতীয় দফায় জরুরি ভিত্তিতে ব্যয় বৃদ্ধি করা হয়েছিল। সর্বশেষ গত বছর জানুয়ারিতে পুনরায় ৩১৫ কোটি টাকা ব্যয় বাড়ানো হয়। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার পরিবর্তন ব্যয় বৃদ্ধির একটা কারণ। তবে বড় কারণ হলো অতিথিশালার তৈজসপত্র, ইলেকট্রনিকস সামগ্রী, আসবাব ও গৃহসজ্জা সামগ্রী কেনা। শেষ পর্যন্ত টানেল নির্মাণ প্রকল্পের ব্যয় দাঁড়ায় ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা।
এটি বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিলে কিছু আয় হবে। তাতে টানেলের লোকসান কমানোর সুযোগ তৈরি হতে পারে।
উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান
আয় কম, বাড়াতে উদ্যোগ
টানেল দিয়ে গত অক্টোবর মাসে দৈনিক গড়ে সাড়ে তিন হাজার যানবাহন চলাচল করেছে। অথচ প্রকল্পের সমীক্ষায় বলা হয়েছিল, টানেল চালু হলে (২০২০ সালে) দিনে ২০ হাজার ৭১৯টি যানবাহন চলবে। প্রতিবছর তা ৬ দশমিক ৪ শতাংশ হারে বাড়বে। ২০২৫ সালে দৈনিক যানবাহন চলাচল দাঁড়াবে গড়ে ২৮ হাজার ৩০৫টি।
যানবাহন চলাচল কম হওয়ায় টানেলের রক্ষণাবেক্ষণ ও টোল আদায়ের ব্যয় উঠছে না। এমন পরিস্থিতিতে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান ১৫ নভেম্বর চট্টগ্রাম সফরে যান। সেখানে তিনি সেতু বিভাগ, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করেন এবং টানেলের লোকসান কমাতে সমন্বিত কিছু উদ্যোগ নেন। তাঁর মতে, এর সুফল হয়তো এখনই পাওয়া যাবে না। তবে ভবিষ্যতে তা কাজে লাগবে।
উদ্যোগগুলোর মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার ও রাঙামাটিমুখী যানবাহনের টার্মিনাল চট্টগ্রাম নগরের দামপাড়া থেকে সরিয়ে মেরিন ড্রাইভের আশপাশে নিয়ে যাওয়া। আশা করা হচ্ছে, এতে শহরের ওপর চাপ কমবে। এখন বাসগুলো শাহ আমানত সেতু দিয়ে চলাচল করে। ওই সেতুর ওপর চাপ কমিয়ে সহজে টানেল ব্যবহার করা যাবে। অবশ্য শাহ আমানত সেতুর তুলনায় টানেলের টোলহার বেশি। বাসে শাহ আমানত সেতুতে টোল ৫০ টাকা, টানেলে তা ৩০০ টাকা।
টানেল ব্যবহার করে কক্সবাজার ও রাঙামাটিগামী বাস চলাচল করার ক্ষেত্রে বাধা আনোয়ারা প্রান্তের সড়ক সরু। তাই আনোয়ারা থেকে চন্দনাইশের গাছবাড়িয়া পর্যন্ত (চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে মিলবে) প্রায় ২০ কিলোমিটার সরু সড়ক সম্প্রসারণ করার নির্দেশ দিয়েছেন সড়ক উপদেষ্টা। এরই মধ্যে সওজ একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এতে কক্সবাজার ও রাঙামাটিগামী বাসগুলোর দূরত্ব কমে যাবে ২০ কিলোমিটারের মতো।
উদ্যোগগুলোর মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার ও রাঙামাটিমুখী যানবাহনের টার্মিনাল চট্টগ্রাম নগরের দামপাড়া থেকে সরিয়ে মেরিন ড্রাইভের আশপাশে নিয়ে যাওয়া। আশা করা হচ্ছে, এতে শহরের ওপর চাপ কমবে।
টানেলটির ব্যবহার বাড়াতে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে আনোয়ারায় আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়নের নির্দেশনা দেন সড়ক উপদেষ্টা। বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে বলা হয়েছে আনোয়ারায় শিল্পায়ন নিশ্চিত করতে। ভবিষ্যতে মাতারবাড়ী জ্বালানি হাবকে (কেন্দ্র) টানেলের সঙ্গে যুক্ত করারও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে অতিথিশালাটি বেসরকারি খাতে পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া যায় কি না, তা খতিয়ে দেখার জন্য কর্মকর্তাদের বলেছেন উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান। তিনি বলেন, এটি বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিলে কিছু আয় হবে। তাতে টানেলের লোকসান কমানোর সুযোগ তৈরি হতে পারে।