পুলিশ কর্মকর্তা হারুনের উত্থানের নেপথ্যে কী?
বিশেষ প্রতিনিধি
দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় হাওরের জীবনযাত্রা অনেক আলাদা। এখানকার মানুষের মন, প্রকৃতির মতোই সুন্দর ও সহজ-সরল। প্রকৃতির সাথে খাপ খাইয়ে নেয়ার সক্ষমতা এই অঞ্চলের মানুষদের পরিচিতি দেয় ভিন্নভাবে। সমাজ বাস্তবতায় হাওর অঞ্চলের মানুষের দেখা মেলে সত্যভাষী ও সাহসী হিসেবে। নিজেদের দায়িত্ব পালনে কখনো পিছপা হতে চান না, কারও কাছে মাথা নত করতেও রাজি নন তাঁরা।
আজ আপনাদের জানাবো কিশোরগঞ্জের মিঠামইন হাওরপাড়ের এক মেধাবী ও সাহসী সন্তানের গল্প। নাম তাঁর মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ। তবে কর্মদক্ষতায় এই পুলিশ কর্মকর্তা পরিচিতি পেয়েছেন ‘এসপি হারুন’, ‘বাংলার সিংহাম’, ‘সিংহ পুরুষ’, ‘গরীবের বন্ধু’, ‘ডিআইজি হারুন’, ‘অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার ডিবি হারুন’ কিংবা ‘ডিবিপ্রধান হারুন’ হিসেবে।
হারুন অর রশীদ ১৯৭৪ সালে কিশোরগঞ্জ জেলার মিঠামইন থানার হোসেনপুর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা আবদুল হাসেম ও মা জহুরা খাতুন। বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হারুন ছোটবেলা থেকেই ছিলেন অসম্ভব মেধাবী। প্রথম শ্রেণি থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজের যেকোনো পরীক্ষায় সবসময় প্রথম স্থান অর্জন করতেন।
কলেজের গণ্ডি পেরুনোর পর, হারুন তাঁর মেধার স্বাক্ষর রেখে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। সেখান থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি এবং এলএলবি সম্পন্ন করেন।
পরবর্তীতে বাংলাদেশ ক্যাডার সার্ভিসের পরীক্ষায় অংশ নিয়ে উত্তীর্ণ হয়ে ২০তম ব্যাচে সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে কর্মজীবন শুরু করেন হারুন-অর-রশীদ। চৌকশ পুলিশ কর্মকর্তা হারুন তাঁর ক্যারিয়ারে ভূ-রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে দায়িত্ব পালনের সুযোগ পান। শুরুতে তিনি ঢাকার মিরপুরের সহকারী কমিশনার হিসেবে যোগ দেন। পরবর্তীতে তিনি গুলশানের সহকারী কমিশনার, তেজগাঁও ও লালবাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার, লালবাগের উপ-কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এসময় ঢাকার রাজপথে সহিংসতা ও নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান ছিল তাঁর।
২০১৪ সালের ২৪ আগস্ট গাজীপুর জেলার পুলিশ সুপার হিসেবে নিয়োগ পান হারুন অর রশীদ। সেখানে অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে চার বছর মেয়াদ পূর্ণ করেন তিনি। গাজীপুরে দায়িত্ব পালনকালে এসপি হারুন হয়ে ওঠেন গরীবের বন্ধু। সাধারণ মানুষের সুরক্ষায় গড়ে তোলেন ফাস্ট রেসপন্স টিম (First Response Team)। মাদক-সন্ত্রাস আর ভূমি দখলে জড়িতদের কাছে ‘এসপি হারুন’ নামটি এক আতঙ্কে পরিণত হয়।
এসপি হারুন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের একটি রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন। কিন্তু পেশাগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে দলীয় লেজুড়ভিত্তিকে দূরে ঠেলে, প্রাধান্য দিয়েছেন নীতি-নিষ্ঠাকে। এ কারণে অনেক অসৎ রাজনৈতিক নেতাদের কাছেও এসপি হারুন এক ভীতির নাম হয়ে ওঠে।
গাজীপুরে সাফল্যের পর এসপি হারুন নারায়ণগঞ্জের দায়িত্ব পান। মাদক-সন্ত্রাসের জনপদ হিসেবে পরিচিত নারায়ণগঞ্জে পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্ব নিয়েই সন্ত্রাসী, মাদক কারবারী আর ভূমি দখলদারদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেন হারুন। অসহায় আর সাধারণ মানুষদের জন্য ত্রাণকর্তা হিসেবে হাজির হন এসপি হারুন। অন্যায়কারীরা যত বড় রাজনৈতিক নেতা, এমপি, কিংবা ব্যবসায়ীই হোন না কেন — হারুন কাউকে পরোয়া করেননি। দল-মত নির্বিশেষে অর্পিত দায়িত্ব পালনে অটল ছিলেন তিনি।
নারায়ণগঞ্জে সাধারণ জনতা হারুনের কর্মকাণ্ডে সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে ‘বাংলার সিংহাম’, ‘সিংহ পুরুষ’ উপাধিতে ভূষিত করে। শহরের অলিগলি, পাড়া-মহল্লায় সাটানো হয় পোস্টার, টাঙানো হয় ব্যানার। অবশ্য সিনেমার সিংহামের মতোই বাংলার সিংহাম হারুনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের কমতি নেই। নারায়ণগঞ্জে মাত্র ১১ মাস কাজ করার এক পর্যায়ে ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে কর্মস্থল বদলি হয় হারুনের। যদিও পরে পুলিশের বিভাগীয় তদন্তে নির্দোষ প্রমাণিত হন হারুন। আর দেশ ও মানুষের সেবার নব-উদ্যমে নিযুক্ত করেন নিজেকে।
নারায়ণগঞ্জের ঘটনায় নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ার পর এই মেধাবী ও চৌকশ পুলিশ কর্মকর্তাকে পদায়িত করা হয় ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগে। এই অঞ্চলে শিল্পাঞ্চল, সংসদ সচিবালয়, প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ও কার্যালয় এবং খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্বাচনী এলাকা থাকায়, এখানে দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তাকে সাহসী ও দক্ষ হতে হয়। বলা হয়, সেসময় তেজগাঁও অঞ্চলে পদায়ন করে মূলত এসপি হারুনের কর্মদক্ষতা আর সততার স্বীকৃতি দেয় সরকার।
করোনাকালে ঢাকা মেট্রপলিটন পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন হারুন-অর-রশিদ। সেসময় জনসাধারণের সেবায় নানামুখী সহায়তা ও সচেতনতামূলক কর্মসূচি পালন করেন তিনি। এছাড়াও মানুষকে ধোঁকা দিয়ে ভুয়া করোনার সনদ বিক্রিতে অভিযুক্ত চিকিৎসক সাবরিনাকে গ্রেপ্তারে শক্ত ভূমিকা পালন করে প্রশংসিত হন তৎকালীন ডিসি হারুন।
২০২১ সালের ১৩ মে পুলিশ সুপার থেকে অতিরিক্ত উপ-পুলিশ মহাপরিদর্শক বা অতিরিক্ত ডিআইজি হিসেবে পদোন্নতি পান হারুন-অর-রশিদ। এর পরপরই ওই বছরের ১৭ মে ডিএমপি গোয়েন্দা বিভাগ উত্তরের দায়িত্ব পান হারুন। তাকে ডিবি উত্তরের যুগ্ম-কমিশনার হিসেবে পদায়ন করা হয়। ওই পদে থাকা অবস্থায় গত বছরের ১৩ জুলাই উপ-পুলিশ মহাপরিদর্শক বা ডিআইজি হিসেবে পদোন্নতি পান তিনি।
এরপর ২০২২ সালের ১৭ জুলাই ডিএমপি গোয়েন্দা শাখার প্রধান হিসেবে নিয়োগ পান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ। আর ডিবি প্রধান হিসেবে হারুন দায়িত্ব পালনের মাত্র ছয় মাসেই সাধারণ মানুষের আস্থার সংস্থায় পরিণত হয় ডিবি।
এই অল্প সময়ে হারুন সহকর্মীদের নির্দেশ দিয়েছেন চাঞ্চল্যকর সব মামলার জট খুলতে। পাশাপাশি সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ কমে এমন বিষয়গুলো প্রাধান্য দিয়ে কাজ করারও নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। ‘বাংলার সিংহাম’-খ্যাত ডিবিপ্রধান হারুন এমন সব কাজ করছেন, যা কেবল সিনেমার সিংহামকেই করতে দেখা যায়। এই যেমন, ১৯ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া মেয়েকে মায়ের বুকে ফিরিয়ে দেয়া; সম্পত্তি বিক্রির টাকা কেড়ে নিয়ে বাবা-মাকে ঘর থেকে বের করে দেয়া সন্তানদের কাছ থেকে টাকা উদ্ধার করে বৃদ্ধ বাবা-মায়ের হাতে তুলে দেয়া, কোলের শিশুকে হারিয়ে দিশেহারা মায়ের বুকে সন্তান ফিরিয়ে দেয়াসহ নানা হৃদয়গ্রাহী কাজ করে যাচ্ছেন ডিবি প্রধান হারুন।
পুলিশ বাহিনীর নানা পর্যায়ের কর্মকর্তারা এখন এক বাক্যে স্বীকার করেন, সময়ের সাহসী ও চৌকশ কর্মকর্তা মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ প্রতিনিয়ত তাঁর কর্মদক্ষতার মাধ্যমে সাফল্যের শিখরে পৌঁছে যাচ্ছেন। এরইমধ্যে দায়িত্ব পালনে কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের ফলে মোট পাঁচ বার পুলিশের সর্বোচ্চ পদক বিপিএম ও পিপিএম অর্জন করেন এই পুলিশ কর্মকর্তা। পুলিশের বেশিরভাগ কর্মকর্তাদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে হারুনের। গাজীপুরের এসপি থাকা অবস্থায় পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ।
চৌকশ পুলিশ কর্মকর্তা হারুন সামাজিক-সাংস্কৃতিক নানা কর্মকাণ্ডেও জড়িত আছেন। তিনি ছাত্র থাকাকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠা করেন কিশোরগঞ্জ জেলা ছাত্র কল্যাণ সমিতি। এছাড়াও ঢাকাস্থ মিঠামইন সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য সচিব তিনি। কিশোরগঞ্জ জেলা সমিতিতে শুরুতে সাধারণ সম্পাদক ও পরবর্তীতে সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন হারুন। আবার বৃহত্তর ময়মনসিংহ সমিতিতে ২০১৮ সাল থেকে সাধারণ সম্পাদকের পদে আছেন। সামাজিক ও কর্মক্ষেত্রের সুবাধে নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আয়োজনে হাজির হন এই মেধাবী পুলিশ কর্মকর্তা। এসব অঙ্গনের বিখ্যাত ব্যক্তিদের সঙ্গে তাঁর রয়েছে সুসম্পর্ক।
ব্যক্তিজীবনে হারুন অর রশীদ বিবাহিত। তাঁর স্ত্রীর নাম শিরিন আক্তার। এক কন্যা ও এক পুত্র সন্তানের জনক-জননী হারুন-শিরিন দম্পতি। হারুনের বাবা ইহলোক ত্যাগ করেছেন। তাঁর মা গ্রামে থাকেন। মা-পাগল হারুন প্রায় প্রতি সপ্তাহের শুক্রবারে মাকে দেখতে ছুটে যান গ্রামের বাড়িতে। এসময় গ্রামের মানুষেরা এসে সুখ-দুঃখের কথা বলেন হারুনের সঙ্গে। এক্ষেত্রে যাকে যতটা পারেন হারুন সহায়তা করেন। এসব কাজ তিনি করে থাকেন কোনো রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ থেকে নয়, একান্তই মানবিক অবস্থান থেকে। নিজের পারিবারিক ও আত্মীয়-স্বজনদের জায়গায় এলাকাবাসীদের বিনোদনের জন্য সম্মিলিত উদ্যোগে একটি বিশাল আয়তনের পার্ক তৈরি করার দায়িত্ব নিয়েছেন হারুন।
ইসলাম ধর্মের অনুসারী হারুন সবসময় নিজ ধর্মের রীতি-নীতি সঠিকভাবে মেনে চলেন, আবার অন্য সকল ধর্মের প্রতিও সহনশীল। দেশের ধর্মীয় আলেমদের সঙ্গে এই পুলিশ কর্মকর্তার রয়েছে সুসম্পর্ক। এরইমধ্যে মা ও পরিবারের সদস্যদের নিয়ে পবিত্র ওমরাহ পালন করেছেন তিনি। এছাড়াও, অসুস্থ মাকে চিকিৎসার জন্য ভারতে নিয়ে গিয়ে, সেখানে একটু সুযোগ পেলেই পরিবারের সদস্যদের নিয়ে হারুন জিয়ারত করে আসেন ‘আজমীর শরীফ’। নিজ এলাকায় মসজিদ, মাদ্রাসার উন্নয়নেও নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন ‘বাংলার সিংহাম’-খ্যাত পুলিশ কর্মকর্তা হারুন অর রশীদ।
মন্তব্য করুন :
